বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলির মধ্যে খাদ্য নিঃসন্দেহে অন্যতম। যখন আপনার গর্ভাবস্থার প্রসঙ্গ আসে, তখন আপনার খাদ্যের উপর নজর রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। গর্ভাবস্থায় কী কী খাবেন এবং কী কী খাবেন না তা জেনে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একজন অন্তঃসত্ত্বা মায়ের হিসাবে দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ যা আপনার ডায়েটে অতি অবশ্যই পূরণ করতে হবে:
- এটির আপনার শরীরকে সঠিকভাবে পুষ্ট করা উচিত।
- এটি ভ্রূণের লালন ও বিকাশে সহায়তা করবে।
গর্ভাবস্থার সময় খেতে হবে এমন প্রয়োজনীয় খাদ্যগুলি কি কি?
-
জল: গর্ভাবস্থার সময় জল খাওয়ার আগে, এটিকে জীবাণুমুক্ত করার জন্য কমপক্ষে 15-20 মিনিটের জন্য ফুটিয়ে নিন।
-
দুধ: এটি ভ্রূণের হাড়গুলির জন্য একটি মজবুত ভিত প্রদান করতে সহায়তা করে। সম্পূর্ণ গর্ভাবস্থা জুড়ে প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় এক কাপ দুধ খান। এটি শিশুর সঠিক শারীরিক, মানসিক এবং বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশ করতে সাহায্য করে।
-
মাখন, সর-তোলা দুধ এবং ঘি: তাজা মাখনের একটি সুশীতল প্রভাব আছে; এটি প্রাণবন্তভাব, শক্তি এবং উদ্যম বাড়ায়; এবং আপনার ত্বকের বর্ণ এবং পৌষ্টিক স্বাস্থ্য উন্নত করে তোলে।অনেক মহিলা গর্ভাবস্থার শেষ ট্রাইমেস্টারে জল ধারণের মুখোমুখি হন। সর-তোলা দুধ এই ফোলাভাব কমাতে সাহায্য করে।ঘি সংবেদনশীল ইন্দ্রিয়গুলিকে শক্তি জোগায় এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে। নিয়মিত ঘি খাওয়া হলে শিশুর বুদ্ধিমত্তা বাড়তে পারে।
-
ক্যালসিয়াম এবং আয়রন ধারণকারী খাদ্যসামগ্রী: আয়রনের অভাবের কারণে ভ্রূণের অসম্পূর্ণ বিকাশ ঘটতে পারে, যেটি সন্তানপ্রসবের সময় বিভিন্ন জটিলতার দিকে পরিচালিত করে। পাতাসহ শাক-সবজিতে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস ছড়িয়ে দিলে ভিটামিন সি-এর একটি ভালো ডোজ পাওয়া যায়, যেটি আয়রনের সবচেয়ে ভালোভাবে শোষণের জন্য অপরিহার্য। কালো কিশমিশ, খেজুর, বিটরুট, বেদানা, আপেল এবং জাফরানও আয়রন বাড়াতে সাহায্য করে। প্রাকৃতিক আয়রনের দুর্দান্ত কিছু উৎস হলো গুড়, গম, সহজে হজমযোগ্য ডাল (যেমন মুগ ডাল এবং হলুদ ছোলা, কখনও সখনও তাদের ভুসি সহ), নারকেল, শুকনো খেজুর এবং পোস্ত।
-
শস্য, ডাল এবং খাদ্যবীজ: দুপুরের খাবার এবং রাতের খাবারে কমপক্ষে এক কাপ সাধারণভাবে রান্না করা ডাল এবং এক কাপ মশলাদার ডাল অন্তর্ভুক্ত করে রাখা উচিত। দৈনিক খাওয়ার ক্ষেত্রে হলুদ ছোলা এবং সবুজ ছোলা ব্যতিক্রম। ভ্রূণের সম্পূর্ণ বিকাশ প্রোটিনের উপর নির্ভরশীল। মুগের মতো হালকা ডালের অঙ্কুরগুলি বিশেষত দুপুরের খাবারের সাথে সারাদিনের ডায়েটে অন্তত একবার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এগুলি খাওয়ার আগে সেদ্ধ করে নিন অথবা রান্না করুন।
-
শস্য: ডাল হজম করা সহজ হয়, যদি তা ভাত বা অন্যান্য রান্না করা শস্যের সাথে খাওয়া হয়। শস্যের দানাগুলিকে পিষে নেওয়ার আগে হালকা ভেজে নেওয়া উচিত, যাতে সেগুলি সহজে হজম করা যায়।
-
মধু (Honey): প্রতিদিন এক থেকে দুই চা চামচ মধু খান। এটি বুদ্ধিমত্তার উন্নতি ঘটায় এবং আপনার গায়ের রং উজ্জ্বল করে। এটি আপনার চোখের পক্ষে উপকারী এবং রক্তকে বিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে।
গর্ভাবস্থার সময় কী কী শাকসবজি খেতে হবে?
নিম্নলিখিত সবজিগুলি সহজে হজম হয় এবং বেশিরভাগ মহিলাদের পক্ষে উপযুক্ত:
- লাউ
-
ঝিঙে
-
ধুঁধুল
-
চালকুমড়ো
-
ঢ্যাঁড়স
-
লাল কুমড়ো
-
আলু
-
করলা
-
ঘেরকিন বা ছোটো শশা
-
পাতাসহ শাকসবজি, যেমন পালংশাক
স্যালাড হিসেবে প্রতিদিন অল্প পরিমাণে শসা, টমেটো, গাজর এবং বিটরুটও খাওয়া যেতে পারে।
বর্ষাকালে, জলে প্রচুর পরিমাণে অশুদ্ধ পদার্থ থাকে, যেগুলি শাকসবজিতে ব্যাকটেরিয়া এবং মাইক্রোবিয়াল সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই বর্ষাকালে সাবধানে শাক-সবজি খান।
গর্ভাবস্থার সময় কী কী ফল খেতে হবে
- আপনার গর্ভাবস্থার সময়ে প্রতিদিন অন্তত একটি মরশুমি ফল - যেমন আঙুর, আপেল, বেদানা এবং কমলালেবু খান।
- যেহেতু গর্ভাবস্থার সপ্তম বা অষ্টম মাসে হঠাৎ করে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড কমে যাওয়া একটি সাধারণ ব্যাপার, তাই এই সময়ের জন্য নারকেলের টাটকা জল একটি স্বাস্থ্যকর পানীয়।
- মাঝেমধ্যে টকজাতীয় ফল যেমন আনারস, স্ট্রবেরি, কদবেল, আতা, পেয়ারা, ন্যাসপাতি এবং তরমুজ খাওয়া উচিত।
- শুকনো ফল - বিশেষ করে বাদাম - অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের জন্য একটি অপরিহার্য জিনিস। এটি বিকাশমান ভ্রূণের মস্তিষ্ককে পুষ্টি দেয়।
- প্রতিদিন একটি করে শুকনো খেজুর চিবিয়ে খান। এর বিকল্প হিসাবে, প্রতিদিন এক গ্লাস দুধের সাথে এক চা চামচ শুকনো খেজুরের গুঁড়ো খান।
- বাড়ন্ত শিশুর পুষ্টি জোগাতে অ্যাপ্রিকট খান। মাঝে মাঝে আখরোট, কাজুবাদাম, পেস্তা খান।
গর্ভাবস্থার সময় কী কী খাওয়া উচিত নয়
- পাকা এবং কাঁচা উভয় প্রকারের আম এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।
- অ-মরশুমি ফল খাওয়া এড়িয়ে চলুন।
- পেঁপে জরায়ু সংকোচনের কারণ হিসাবে পরিচিত এবং এটি এমনকি গর্ভপাত পর্যন্ত ঘটাতে পারে। তাই গর্ভবতী মহিলাদের কখনই এগুলি খাওয়া উচিত নয়।
- অতিরিক্ত পরিমাণে ফলের স্যালাড এবং মিল্কশেক খাওয়া কমিয়ে দিন।
- মিষ্টি আলু এবং মাশরুমের মতো সবজি হজম করা কঠিন। ক্যাপসিকাম, বেগুন, পেঁয়াজকলি এবং ক্লাস্টার বিনসও খুব কম খাওয়া উচিত।
- গাজর বা টমেটো জুস গ্রহণযোগ্য নয়। আপনি মাঝে মাঝে টমেটো স্যুপ খেতে পারেন।
গর্ভাবস্থার সময় বমি হওয়ার পরে কী খাওয়া উচিত
অল্প পরিমাণে খুব কম গন্ধ সহ ঠান্ডা বা ঘরের তাপমাত্রায় সাধারণ খাবার গ্রহণ করুন। আপনি হোয়াইট ব্রেড টোস্ট, ম্যাশড আলু, ফল, সাদা চাল, সাধারণ গরম সিরিয়াল এবং সাধারণ হোয়াইট পাস্তা খেতে পারেন।
গর্ভাবস্থার সময় লো ব্লাড প্রেশারের জন্য যা যা খাবেন
মিনারেল ও ভিটামিন সমৃদ্ধ ফল এবং শাকসবজি খান। ভারী খাবার একেবারে খাবেন না। এটিকে নিয়মিত বিরতিতে ছোটো ছোটো খাবারে সীমিত করে ফেলুন।
গর্ভাবস্থার প্রথম এবং দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে কী খাবেন?
গর্ভাবস্থার প্রথম ট্রাইমেস্টারে আপনাকে অতি অবশ্যই কী কী খেতে হবে এবং গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে কী কী খেতে হবে তার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। এখানে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলির একটি তালিকা রয়েছে:
- প্রথম ট্রাইমেস্টার: ফোলেট-সমৃদ্ধ খাবার, ভিটামিন বি 6, উপরে আলোচনা করা ফল গুলি, দুগ্ধজাত খাবার এবং আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খান।
- দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার: আপনার আয়রন, ভিটামিন সি, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার, ক্যালসিয়াম, ফোলেট, ভিটামিন ডি এবং ওমেগা -3 ফ্যাটি অ্যাসিড খাওয়া উচিত। এছাড়াও, আপনার তরল পদার্থের গ্রহণ বাড়ান।
উপসংহার
গর্ভে থাকাকালীন নয় মাস ধরে আপনার শিশু বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাবে। গর্ভাবস্থার সময় কী কী খেতে হবে তা জানা এবং একটি স্বাস্থ্যকর ডায়েট খাওয়া আপনার শিশুর সঠিক বিকাশের জন্য সবসময় সবচেয়ে ভাল জিনিস। আপনার স্বাস্থ্য এবং আপনার শিশুর বিকাশের জন্য আয়রন, ফোলেট সমৃদ্ধ খাবার, দুগ্ধজাত প্রোডাক্ট যেমন সর-তোলা দুধ, মাখন, এবং ঘি, শুকনো ফল এবং বিভিন্ন মরশুমি ফল অপরিহার্য। এই সময়কালে আপনি আপনার ডায়েটের মধ্যে যে যে খাবারগুলি ধরে রাখতে হবে এবং যে যে খাবারগুলি বাদ দিতে হবে, তার একটি তালিকা হাতের কাছে রাখা নিশ্চিত করুন।