ভূমিকা
প্ল্যাসেন্টা একটি গুরুত্বপূর্ণ, তবে সাময়িক অঙ্গ, যেটি প্রয়োজনীয় পুষ্টি, রক্ত ও অক্সিজেন দিয়ে শিশুর যত্ন নেওয়ার জন্য মহিলার দেহে গর্ভধারণের সময় তৈরি হয়। এটি ভ্রূণের শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ দূর করে। সাধারণত আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে গর্ভাবস্থার প্রথম কয়েক সপ্তাহে প্ল্যাসেন্টার বৃদ্ধি বোঝা যায়। প্ল্যাসেন্টা গর্ভের লাইনিংয়ে নিজেকে যুক্ত করে। প্ল্যাসেন্টা তার সংযুক্তি থেকে সরে না, তবে গর্ভাবস্থায় যত সময় যায়, এটি জরায়ুর বৃদ্ধি অনুযায়ী আকারে (প্ল্যাসেন্টার মাইগ্রেশন) পৃথক হতে পারে।
লো-লাইং প্ল্যাসেন্টা কী?
প্ল্যাসেন্টা যখন সার্ভিক্সের (জরায়ুর নীচের অংশ, যেখান দিয়ে শিশুকে বের করা হয়) কাছে জরায়ুর নীচের অংশে যুক্ত থাকে, তখন আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে লো-লাইং প্ল্যাসেন্টা বোঝা যায়।
গর্ভাবস্থার 12তম সপ্তাহে ট্রান্সভ্যাজাইনাল স্ক্যানের মাধ্যমে লো-লাইং প্ল্যাসেন্টা বোঝা যায়। তবে, প্রসব যন্ত্রণা ও গর্ভাবস্থায় খুব কম সমস্যা বা কোনও সমস্যা সৃষ্টি না করে প্ল্যাসেন্টা উপরদিকে উঠে যেতে পারে। কিন্তু কিছু বিরল ক্ষেত্রে প্ল্যাসেন্টা ভ্রূণের জন্মের পথ আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে আটকে সার্ভিক্সের উপর থাকে। এই অবস্থাকে প্ল্যাসেন্টা প্রিভিয়া বলে।
প্ল্যাসেন্টা প্রিভিয়া প্রসবের সময় ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। অ্যান্টিরিয়র লো-লাইং প্ল্যাসেন্টা এমন একটি অবস্থা, যখন প্ল্যাসেন্টাটি জরায়ুর সামনের পৃষ্ঠে আটকে থাকে। পোস্টিরিয়র লো-লাইং প্ল্যাসেন্টার ক্ষেত্রে এই ঘটনাই জরায়ুর পিছন দিকের পৃষ্ঠে হয়। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা এই ধরনের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় আপনাকে সাহায্য করবেন। অনেক গবেষণা অনুযায়ী লো-লাইং প্ল্যাসেন্টার অর্থ হল শিশুটি ছেলে।
লো-লাইং প্ল্যাসেন্টার কারণগুলি কী-কী?
লো-লাইং প্ল্যাসেন্টা বিভিন্ন কারণে হতে পারে:
- গর্ভাবস্থায় ধূমপান বা ড্রাগ নেওয়া হলে লো-লাইং প্ল্যাসেন্টা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- জরায়ুর আশেপাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে কোনও বড় সার্জারি হয়ে থাকলে গর্ভাবস্থায় প্ল্যাসেন্টার অবস্থান প্রভাবিত হতে পারে।
- 35 বছরের উপরের মহিলাদের গর্ভাবস্থায় প্ল্যাসেন্টার অবস্থান নীচের দিকে হতে পারে।
- আগে কখনও গর্ভপাত হয়ে থাকলে লো-প্ল্যাসেন্টা হতে পারে।
- আগের প্রসব সিজারিয়ান হয়ে থাকলে পরবর্তী গর্ভাবস্থায় এটি হতে পারে।
- গর্ভধারণের জন্য ফার্টিলিটি চিকিৎসা, যেমন ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন করানো হলে এটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- মা যখন দ্বিতীয়বার গর্ভধারণ করেন অথবা দুই বা তার বেশি ভ্রূণ বহন করেন, তখন প্ল্যাসেন্টা নীচের দিকে থাকতে পারে।
গর্ভাবস্থায় এই পরিস্থিতি হওয়ার অনেক কারণ আছে, কিন্তু অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে লো-লাইং প্ল্যাসেন্টা ঠিক করা যায়। এছাড়া আপনার প্ল্যাসেন্টা যদি নিচু অবস্থানে হয়, তাহলে লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে জানার জন্য আপনি যে-কোনও সময় আপনার ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
লো-লাইং প্ল্যাসেন্টার লক্ষণগুলি কী-কী?
লো-লাইং প্ল্যাসেন্টার নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি থাকতে পারে। যদি এর মধ্যে এক বা একাধিক লক্ষণ থাকে, তাহলে আপনার ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করুন:
- প্রথম কয়েক সপ্তাহে সামান্য রক্তপাত গর্ভধারণের লক্ষণ হলেও, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রাইমেস্টারেও রক্তপাত হতে পারে। এটি প্ল্যাসেন্টা প্রিভিয়ার সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ।
- গর্ভে একটি শিশু সাধারণত তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে (30 থেকে 34 সপ্তাহ) যুক্ত হয়, কিন্তু যেসব মায়েদের লো-লাইং প্ল্যাসেন্টা থাকে, তাঁরা শেষ কয়েকটি সপ্তাহেও শিশুদের ব্রিচ বা অন্যান্য অস্বাভাবিক অবস্থানে পেতে পারেন।
- ঋতুস্রাবের অস্বস্তির মতো যন্ত্রণা হতে পারে। এক্ষেত্রেও রক্তপাত হয়।
- গর্ভাবস্থায় ব্লাড সুগার ও রক্তচাপের মাত্রা সবসময় পরীক্ষা করা প্রয়োজন। কোনও মহিলার প্ল্যাসেন্টার অবস্থান নীচের দিকে হলে তাঁর রক্তচাপ বেশি হবে (প্রি-এক্ল্যাম্পসিয়া)।
লো-লাইং প্ল্যাসেন্টায় কী-কী ঝুঁকি থাকে?
লো-লাইং প্ল্যাসেন্টার ঝুঁকিগুলির মধ্যে রয়েছে:
- নির্ধারিত সময়ের আগেই শিশুর জন্ম দেওয়া।
- শিশুদের বৃদ্ধি সীমাবদ্ধ হতে পারে অথবা কোনও জন্মগত প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে।
- এছাড়া, মায়ের কখনও-কখনও খুব বেশি রক্তপাত হতে পারে, যার ফলে হিস্টেরেক্টমি (যখন মায়ের গর্ভ বাদ দিয়ে দেওয়া হয়) করা হতে পারে।
- কিছু ক্ষেত্রে, পোস্টিরিয়র লো-লাইং প্ল্যাসেন্টা তখন হয়, যখন অভ্যন্তরীণ O-এর (সার্ভিক্সের কেন্দ্রের খোলা মুখ) কাছাকাছি পৌঁছনোর জন্য এটি কাছাকাছিই থাকে, ফলে প্রসবের সময় সমস্যা হয়।
- লো-লাইং প্ল্যাসেন্টার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি হল মায়ের উদ্বেগ খুব বেশি হতে পারে এবং প্রক্রিয়াগুলির সময় তিনি সহযোগিতা করতে অক্ষম হতে পারেন।
লো-লাইং প্ল্যাসেন্টা থাকলে কী ধরনের সতর্কতা ও চলাফেরার সীমাবদ্ধতা মেনে চলতে হবে?
ডাক্তার ও চিকিৎসার মাধ্যমে প্ল্যাসেন্টা প্রিভিয়া আটকানো না গেলেও তাঁরা আপনাকে সবসময় বিভিন্ন নির্দেশ দিয়ে এবং ভ্রূণ ও মায়ের সুস্থতার জন্য অবিরাম দেখাশোনা করে আপনাকে সাহায্য করবেন:
- প্রসব যন্ত্রণার সময় মাকে রক্ত দিতে হলে, ডাক্তাররা তা আগে থেকে ব্যবস্থা করে রাখবেন।
- স্বাস্থ্যকর খাবার খেলে ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলে গর্ভাবস্থায় রক্তাল্পতা হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
- সহবাসের পরে রক্তপাত হলে আপনার ডাক্তার আপনাকে সহবাস না করার পরামর্শ দিতে পারেন।
- নিয়মিত কঠিন শরীরচর্চা না করা এবং নিয়মিত চেক-আপ করানো আপনাকে পজিটিভ থাকতে সাহায্য করবে।
- লো-লাইং প্ল্যাসেন্টা থাকলে ঘুরতে না যাওয়াই ভাল। বিমানে ভ্রমণ এড়িয়ে চলুন।
- 32-সপ্তাহ পরে অন্যান্য মাধ্যমেও বেশি দূরে ভ্রমণে না যাওয়ার চেষ্টা করুন।
- আপনার ডাক্তার প্ল্যাসেন্টা প্রিভিয়ার প্রভাবগুলি সামলানোর জন্য আপনার কতটা বেড রেস্ট প্রয়োজন, সে-বিষয়ে নির্দেশ দেবেন।
- চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেন যে লো-লাইং প্ল্যাসেন্টা থাকলে বাঁদিকে ফিরে শোয়া ঠিক, যাতে শিরা-উপশিরায় চাপ না থাকে এবং রক্ত সরবরাহ আরও ভালভাবে হয়।
- লো-লাইং প্ল্যাসেন্টার ক্ষেত্রে বসার জন্য কোনও বিশেষ নির্দেশ না থাকলেও, বেশিক্ষণ বসে না থাকার চেষ্টা করুন।
লো-লাইং প্ল্যাসেন্টায় কী ধরনের চিকিৎসা প্রয়োজন?
- আপনাকে বারেবারে স্ক্যান করার জন্য হাসপাতালে যেতে বলা হবে। যেমন, যদি 20তম সপ্তাহে আপনার আল্ট্রাসাউন্ডে লো-লাইং প্ল্যাসেন্টার লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে প্ল্যাসেন্টার অবস্থান দেখার জন্য 32তম সপ্তাহে আরেকবার স্ক্যান করা হবে।
- 36তম সপ্তাহেও যদি লক্ষণ ও সার্ভিক্সের বাধা দেখা যায়, তাহলে ডাক্তার আপনার সম্মতি নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের আগে আপনার প্রসবের পরিকল্পনা করবেন।
- এর ফলে মা ও শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। যদি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই প্রসব যন্ত্রণা হয়, তাহলে ভ্রূণের ফুসফুসগুলিকে পুরোপুরি তৈরি করার জন্য 34তম সপ্তাহে আপনাকে স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন দেওয়া হবে।
- কখনও-কখনও পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু হয় না, বিশেষ করে প্রসবের আগে যদি অত্যধিক রক্তপাত হয়। এর ফলে আরও জটিলতা এড়ানোর জন্য ডাক্তার আপদকালীন সি-সেকশন করতে পারেন।
- লো-লাইং প্ল্যাসেন্টাতে অবিরাম নজর রাখা প্রয়োজন, তাই অনুগ্রহ করে আপনার কনসাল্টেশন ও নির্ধারিত স্ক্যানগুলি বাদ দেবেন না। বরং আপনার ও আপনার সন্তানের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সবকিছু জানার জন্য আপনার ডাক্তারকে প্রশ্ন করুন।
- দ্রুত রোগনির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসাগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে আপনি ও আপনার সন্তান, দু’জনেই জন্মের সুন্দর অভিজ্ঞতা পেতে পারেন।
সারসংক্ষেপ
- লো-লাইং প্ল্যাসেন্টা এমন একটি অবস্থা, যখন প্ল্যাসেন্টা জরায়ুর নীচের দিকে যুক্ত হয়ে থাকে, সাধারণত সার্ভিক্স ঢেকে থাকে।
- এটি আগের প্রসবের অভিজ্ঞতা, ধূমপান বা ড্রাগ নেওয়া, গর্ভপাত ও বেশি বয়সে গর্ভধারণের জন্য হতে পারে।
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভধারণের 30 সপ্তাহ পরে প্ল্যাসেন্টার অবস্থান ঠিক হয়ে যায়।
- যদি তৃতীয় ট্রাইমেস্টারেও লো-লাইং প্ল্যাসেন্টা থেকে যায়, তাহলে রক্তপাত, প্রসবে সমস্যা ও নির্দিষ্ট সময়ের আগে প্রসব হতে পারে।
- এই ধরনের ক্ষেত্রে ডাক্তাররা নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা সিজারিয়ান প্রসবের পরামর্শ দিতে পারেন।
- স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করা প্রয়োজন, নিয়মিত চেক-আপ করান এবং এই ধরনের গর্ভাবস্থায় চলাফেরার সীমাবদ্ধতাগুলি মনে রাখবেন।